আসসালামুআলাইকুম বন্ধুরা। আশা করি সকলেই ভালো আছেন। সিলেট ভ্রমণের ২য় পর্বে আপনাদের কে স্বাগতম।
গত পর্বে শেয়ার করেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে সিলেট ট্রেন ভ্রমন। সিলেট আসার পর রাতে আমার বন্ধু মোক্তার এর বাসায় থাকি। সকালেই আমরা বেড়িয়ে পরি মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে । আজ প্রথমে আমরা যাবো হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজারে। চলুন যেতে যেতে হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
৩৬০ আউলিয়ার সিলেট নগরী ‘পূন্যভূমি’ হিসাবে খ্যাত। সিলেটের মাটিতে যেসব পীর, দরবেশ শায়িত আছেন এদের মধ্যে হযরত শাহজালাল (রঃ) অন্যতম। আর এজন্য তাঁকেতাঁ ওলিকুল শিরোমণি বলা হয়। হযরত শাহ জালাল (রঃ) সকল ধর্মেরর্মে মানুষের কাছে সমাদৃত ছিলেন। প্রতি বছর হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার জিয়ারতে ধর্ম-র্মবর্ণ নির্ণ র্বিশের্বি ষে মানুষের ঢল দেখা করা যায়।
আমরা এখন চলে এসেছি মাজারের কাছে এই এলাকাটিকে দরগা এলাকা এবং প্রবেশ পথটিকে দরগা গেইট বলা হয়। দেখলে মনে হয়, আভিজাত্যপূর্ণ এইর্ণ দরগা গেইটই মাজারের পথে প্রবেশের ভাবমূর্তি ধরে রেখেছে। এই দরগা গেইটের সৌন্দরর্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নেওয়া পাতাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য। এই গেইটের আশেপাশে পাতাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়েনের ফলে বৈদ্যুতিক কোন তার দৃষ্টিগোচর হয় না, সব তার মাঠির নিচে থাকায় দরগা গেইটের সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাজার গেইটের ভিতরে ডুকতেই হাতের ডান পাশে চোখে পরবে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর জনশ্রুতি আছে, হযরত শাহজালাল (র:) এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা জানতে পেরে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (র:) তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং নিদর্শনর্শ স্বরূপ তাকে একজোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। সেই কবুতরই বর্তমানে জালালী কবুতর নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। সিলেটে জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেউ ই এ কবুতর বধ বা খায় না। বরং অধিবাসীরা এদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে থাকে। শাহজালালের (র.) মাজার এলাকায় প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়তে দেখা যায়। মাজার কর্তৃপক্ষ এসব কবুতরের খাবার সরবরাহ করে থাকেন। মাজারের ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর মাজারে আগতদের বিনোদিত করে থাকে।
মাজারের পূর্ব দিকে একতলা ঘরের ভেতরে বড় তিনটি ডেকচি রয়েছে। এগুলো ঢাকার মীর মুরাদ দান করেছেন বলে জানা যায়। মীর মুরাদ ঢাকার হোসেনী দালান তৈরী করেন। যদিও ডেকচিগুলোতে রান্নাবান্না হয় না, তবুও কথিত আছে প্রত্যেকটিতে সাতটি গরুর মাংস ও সাত মণ চাল একসাথে রান্না করা যায়। পূণ্যের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ডেকচিগুলোতে প্রচুর টাকাপয়সা দান করেন।
হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার চত্বরের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরে রয়েছে অসংখ্য গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র জ্ঞানকরে দর্শনার্থীরা ছোট ছোট মাছ খেতে দেয়। পুকুরের পশ্চিম কোণে ছোট মাছ বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। পুকুরে অজুরজু ব্যবস্থাও আছে। ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিষ প্রয়োগে পুকুরের প্রায় ৭শ’রও বেশি গজার মাছ হত্যা করা হয়। ফলে পুকুরটি গজার মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। মরে যাওয়া মাছগুলোকে মসজিদের পশ্চিম দিকের গোরস্থানে পুঁতেপুঁ ফেলা হয়। পুকুরটি মাছ শূন্য হয়ে যাওয়ার পর হযরত শাহজালাল (র.) এর অপর সফরসঙ্গী মৌলভীবাজারের শাহ মোসত্মফার (র.) মাজার থেকে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ২৪ টি গজার মাছ এনে পুকুরে ছাড়া হয়। বর্তমানে পুকুরের গজার মাছের সংখ্যা কয়েক শ’তে দাঁড়িয়েছে বলে জানা যায়।
এর পর আমরা মাজারের পাশ দিয়ে কূপ দেখার জন্য যায়। লোকশ্রতি আছে যে হযরত শাহজালাল (র.) একটি কূপ খনন করার আদেশ দিয়ে প্রার্থনা করেন আল্লাহ যেন এই কূপটিকে জমজমের কূপটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেন। এরপর তিনি লাঠি দিয়ে মাটির ওপর আঘাত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে এই কূপটির সাথে জমজমের কূপের মিলন ঘটে গেল। তারপর এর চারপাশ পাকা করে দেওয়া হলো এবং উত্তর পার্শ্বে দুটি পাথর বসিয়ে দেওয়া হলো-যা থেকে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয়।
এর পর আমরা দরগাহ মসজিদ এবং মাজার দেখার জন্য মসজিদে প্রবেশ করি কিন্তু আজ মাজারের দরজায় তালা দেওয়া। এর পর প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ্ এর কবর দেখার লোভ টা সামলাতে পারলাম না । তাই আমরা তার কবরস্থান দেখার জন্য ভিতরে ডুকি। এই হলো সালমান শাহ্ এর কবরস্থান।
দরগাহ মসজিদটি বাংলার সুলতান আবুমুজাফ্ফর ইউসুফ শাহের মন্ত্রী মজলিশে আতার আমলে ১৪০০ সালে দরগাহ চত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৭৪৪ সালে বাহরাম খাঁ ফৌজদারের সময় এটি পুনর্নির্মিত হয়। বর্তমানে এটি সিলেট শহরের অন্যতম একটি মসজিদ।
আমাদের এবারের গন্তম্য হলো হযরত শাহ পরানের মাজার। হযরত শাহ জালালের মাজার থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে খাদিম নগরে একটি টিলার উপরে হযরত শাহ পরানের মাজার অবস্থিত। আমরা ১৫০ টাকা দিয়ে সিএনজি রিজার্ভ নিয়ে রওনা হলাম। চলুন যেতে যেতে হযরত শাহ পরানের মাজার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
হযরত শাহপরাণ ছিলেন সুহরাওয়ারদিয়া এবং জালালীয়া বংশের একজন সূফী সাধক। বলা হয়ে থাকে ইয়েমেনের হাদরামুতে জন্মগ্রহণকারী হযরত শাহপরাণ (রঃ) ছিলেন হযরত শাহজালালের বোনের ছেলে। তিনি তাঁর মামা হযরত শাহজালালের সাথে ভারতে আসেন এবং ১৩০৩ সালে শাহজালালের নেতৃত্বে সিলেট অভিযানে অংশ নেন। সিলেট অধিগ্রহনের পর শাহপরাণ (রঃ) সিলেট শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে দক্ষিনগড় পরগণার খাদিমনগরে খানকাহ স্থাপন করে সূফী মতবাদভিত্তিক আধ্যাত্মিক চর্চা ও কর্মকাণ্ড শুরু করেন। সিলেট অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা ও ইসলামের প্রচারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। কিভাবে এবং কখন হযরত শাহপরাণ (রঃ) মৃত্যুবরণ করেন তা জানা যায়নি তবে তাঁকে দাফন করা হয় তাঁরই খানকার পাশে। শতবছর ধরে আজ অবধি অসংখ্য মানুষ তাঁর দরগায় আসেন। প্রতি বছর আরবী রবিউল আউয়াল মাসের ৪, ৫, ও ৬ তারিখে হযরত শাহপরাণের উরশ অনুষ্ঠিত হয়।
মেইন রোগের উপরেই মাজারের তোরণ তৈরি করা আছে, দেখেই চেনা যায়। কিছু দুর পর থেকেই রাস্তার ধারে গড়ে উঠেছে নানান জিনিসের সম্ভার নিয়ে ছোট ছোট দোকান। মোম বাতি, আগড় বাতি, আতর, মালা, তাবিজ, হালুয়া কি নেই এখানে! তবে এই মাজারে দেখেছি হাতে হাতে নিয়ে এসে মোম বাতি, গোলাপজল বিক্রি করছে। আর তাবিজ বিক্রেতাও রয়েছে প্রচুর। সাবধান থাকতে হবে এদের হাত থেকে।
মাজার প্রাঙ্গণের সামনেই আছে একটি বিশাল পুকুর, শেওলা ধরা সবুজ জলেই চলে অজুর আর গোসল। অবশ্য পাশেই অজুর জলের ব্যবস্থা আছে। শুনেছি অনেকেই মানত করে এখানে গোসল করার। আমাদের কোন মানত ছিল না পালন করার মত।
ছোট্ট একটি টিলার উপরে মাজারটি অবস্থিত। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে উঠতে হয় মাজারে। মাজারের সামনেই পশ্চিম পাশে আছে একটি সুন্দর মসজিদ। মাজারে মূল অংশে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। টিলার পাশে সিঁড়ির আগেই মহিলাদের নামাজ পড়ার যায়গা আছে।
সিঁড়ির বাম দিকে একটা খাদেমদের অফিস ঘরের মত আছে। কবরটির উত্তরে “আশাগাছ” নামে একটি প্রাচীন বৃক্ষ আছে যেটির ডালপালা পুরো দরগার ওপর ছড়িয়ে রয়েছে। গাছটির পাতা কাছ থেকে দেখলে মনে হয় যে গাছটি আম, ডুমুর এবং অন্য কোন গাছের সমন্বয়ে বেড়ে উঠেছে। এই সিঁড়ি বেয়েই পুরুষদের খালি পায়ে ঢুকতে হয় মাজারে। মাজারের সাথেই আছে কোরআন পড়ার স্থান। বিশাল গাছ ছায়া দিয়ে আছে মাজারের উপরে। ধারনা করতে পারি এটাই সেই কথিত আশা গাছ। শাহ পরানের কবর উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। অনেকেই সেই দেয়াল ধরে দাড়িয়ে আছি, মোনাজাত করছে। তাঁর কবরটি একটি উঁচু পাহাড়ের ওপর ইট দিয়ে বাঁধানো এবং দেয়াল দিয়ে ঘেরা অবস্থায় সুরক্ষিত আছে। এই দরগার পাশেই একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। ১৯৮৯-৯১ সালে মসজিদটির আধুনিকীকরন করা হয় এবং এখানে প্রায় ১৫০০ জন মুসলিম একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন